‘ফয়েজ জন্মবিপ্লবী। ফয়েজ কমিউনিস্ট। মার-খাওয়া মানুষের জন্য হক কথা বলার অপরাধ তাঁর বরাবর। স্বদেশে বিদেশে যেখানেই থাকুন, ফয়েজ তাঁর লেখায় ও জীবনে কখনো লুঠেরা মানুষের সঙ্গে সমঝোতা করেননি। প্রাক্তন ব্রিটিশ শাসকরাও তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি। ফলে, তাঁর দেশ ও জন্মভূমি আজ তাঁর কাছে দুস্তর প্রবাস। এই তো সেদিন-ও জাঁহাবাজ ইজরায়েলের লোভের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া লেবাননের অগ্নিব্যূহের মধ্যে আমরা অশান্ত পায়ে হাঁটতে দেখেছি ঐ মানুষটিকে।… ফয়েজ আমাদের দেশকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। পরম আবেগে বারবার উচ্চারণ করেছেন এ-দেশের মানুষের অপ্রতিরোধ্য লড়াই-এর কথা। আমরা তাই ফয়েজ-কে ভালোবাসি। ফয়েজ এই উপমহাদেশের গর্ব।’
–অমিতাভ দাশগুপ্ত
প্রথমে পাকিস্তানে। এখন ভারতে।
নিষিদ্ধ ‘জাগো হুয়া সাভেরা’।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ অবলম্বনে যে ছবির চিত্রনাট্য, গানের কথা লিখেছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। যে ছবি আক্ষরিক অর্থেই ছিল পাকিস্তান, ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অসাধারণ সব কলাকুশলীদের এক যৌথ প্রয়াস। ফয়েজ ছাড়া আর একজনই ছিলেন পাকিস্তানি। পরিচালক আবদুর রশিদ কাদের। যিনি বলিউডকে দিয়েছেন নৌশাদ, মজরু সুলতানপুরির মতো শিল্পীকে, সুরাইয়ার মতো অভিনেত্রীকে। যাঁর দুলারি ছবিতে মহম্মদ রফির প্রথম হিট গান ‘সুহানি রাত ঢল চুকি হ্যায়’। ছিলেন গণনাট্য সঙ্ঘের দাপুটে অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। পূর্ব পাকিস্তানের অভিনেতা আতাউর রহমান আর কাজী খালেক। সংগীত পরিচালনায় ভারতের তিমিরবরণ। ক্যামেরায় অস্কারজয়ী ব্রিটিশ চিত্রপরিচালক ওয়াল্টার লাসালি। ছবিটির শুটিং হয় ঢাকার কাছে, মুন্সিগঞ্জের এক গ্রামে, মেঘনার কোলে।
মে, ১৯৫৯। ইসলামাবাদে জেনারেল আয়ুব খানের সামরিক শাসন। করাচির জুবিলী হলে মুক্তির তিনদিন পরেই নিষিদ্ধ হয়ে যায় জাগো হুয়া সাভেরা। অভিযোগ ছবিটি ‘কমিউনিস্ট ভাবধারার’, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রনাট্যকার–সবাই কমিউনিস্ট। লন্ডনে ছবিটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানের চেষ্টা হলে সামরিক সরকার সেখানে পাক হাইকমিশনারকে ওই অনুষ্ঠান বয়কটের নির্দেশ দেয়। যদিও, সেই নির্দেশ অমান্য করে সস্ত্রীক হাজির ছিলেন পাক হাইকমিশনার।
অক্টোবর, ২০১৬। দিল্লিতে মোদী। মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবে নিষিদ্ধ করা হয় জাগো হুয়া সাভেরা। সংঘর্ষ ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আপত্তির জেরে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই ক্লাসিক ছবির প্রদর্শন। ফাউন্ডেশন পুলিশের কাছে জানায়, ‘অন্য কোনও ছবিতে আপত্তি নেই, কিন্তু পাকিস্তানের কোনও ছবি যেন দেখানো না হয়।’ অথচ, তার ক’দিন আগেই ছবিটি দেখানো হয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসবে।
কাঁটাতারের দু’পারেই কট্টরপন্থীদের হাতে আক্রান্ত ফয়েজ।
ফয়েজের উপর আক্রমণ তাই নতুন নয়। সীমান্তের দু’পারে দুই মৌলবাদেরই শিকার তিনি। ফয়েজ যতটা পাকিস্তানি, ততটাই ভারতীয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯১১। জন্ম শিয়ালকোটে। যে শহরে জন্মেছেন আরেকজন মহান কবি মহম্মদ ইকবাল। পড়েছেন স্কচ মিশন হাইস্কুলে, যে স্কুলে একসময় পড়তেন ইকবাল। অধ্যাপনা অমৃতসরের মেয়ো কলেজে, যে শহরে বসে মান্টো লিখেছেন তাঁর প্রথম গল্প ‘তামাশা’, জালিয়নওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন দিল্লিতে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে। বিয়ে করেন শ্রীনগরের মেয়েকে। দেশভাগের পরেও ভারতের প্রতি যাঁর ছিল বুকভরা আবেগ আর যন্ত্রণা। যাঁর দুই কন্যার জন্ম এই ভারতে। সালিমার দিল্লিতে, মুনিজার সিমলায়। যিনি কখনও মেনে নিতে পারেননি দেশভাগকে। মর্সিয়া নামে তাঁর চার লাইনের একটি কবিতায় এই নৈকট্য আর দূরত্বের ছিল এক অস্বাভাবিক মোচড়। ‘দূরে গিয়ে যতটা আছ কাছে/ এতটা কাছে আমার কবে ছিলে তুমি/ এখন না আসবে না যাবে তুমি/ মিলন বিরহ কতটা হয়ে গেছে একাকার।’
১৯৪৭, পাকিস্তান টাইমসের সম্পাদকীয়তে ফয়েজ যেমন লিখেছিলেন, ‘মুসলিমরা পেয়েছেন পাকিস্তানকে, হিন্দু আর শিখরা পেয়েছেন তাদের খণ্ডিত বাংলা আর পাঞ্জাবকে। কিন্তু আমি এখনও সেই মানুষটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, যিনি তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই উৎসাহী। আমি মনে করতে পারছি না এমন আর কোনও দেশকে, যার জনগণ এমন দুর্দশার মধ্যে ছিলেন তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সময়।’
যে আবেগের তীব্র রক্তক্ষরণ ছিল তাঁর ‘সুবহ্-এ-আজাদী’তে।
দেশভাগের ঘোষণার ক’দিন বাদে ফয়েজ কবিতাটি লিখেছিলেন নিদারুণ যন্ত্রণায়। সীমান্তের দু’পারে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা, জীবিকা হারিয়ে সবহারা উদ্বাস্তু স্রোত, ধর্ষণ। দেখে ফয়েজের বিস্ময়, এই স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়েছিলাম? ভারত, পাকিস্তানকে ভাগ করে যে স্বাধীনতা এসেছে, আমরা কি আদৌ তেমন কখনও চেয়েছিলাম? আমরা কি সত্যিই মুক্ত? ঋত্বিকের ‘কোমল গান্ধার’, মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’র মতোই ফয়েজের ‘সুবহ্-এ-আজাদী’। কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের অনুবাদে ‘আজাদির সকাল’।
‘এই গোমরামুখো ভোর
রাতের কালো দাঁতগুলিকে ঢাকতে পারেনি।
বড় দীর্ঘদিন আমরা যার অপেক্ষায়
এ-তো সেই সকাল নয়।
আমাদের কমরেডরা
যারা বিশ্বাস করেছিল শূন্যের এই বিপুল নীলিমায়
কোথাও না কোথাও তাদের ঘুমোনোর জায়গা আছে,
আছে অন্ধকারে ধীরে ধীরে ধুয়ে মুছে দেয়ার মত জোয়ার,
দুঃখের অর্ণবপোতটিকে কাছিতে বেঁধে ফেলার বন্দর–
যে ঝলমলে ভোরের খোঁজে
এইসব ভেবে তারা ঘর ছেড়েছিল–
এ-তো সেই সকাল নয়।’
সত্তর বছর বাদে, ২০১৬-তে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে আবার উঠেছে সেই স্লোগান। এবারে এক অন্য সময়, অন্য প্রেক্ষিত। তিহার থেকে মুক্ত কানহাইয়া, উমর খালিদ, অনির্বাণ ।
ক্যাম্পাসে স্লোগান: ভুখমারিসে আজাদী! ভেদভাবসে আজাদী! পক্ষশবাদ সে আজাদী! মনুবাদ সে আজাদী! সঙ্ঘবাদ সে আজাদী! তুম কুচ ভি কারলো, আজাদী!
আটের দশকে নারীবাদী, প্রয়াত কবি কমলা ভাসিন লিখেছিলেন, আপনি মর্জি সে খুলকার জিনা, হ্যায় আজাদী/ জো মন মে হ্যায় খুল কার কেহানা, হ্যায় আজাদী/ আপনি শরীর পর হক আপনা, হ্যায় আজাদী।
ভাসিনের থেকেই এই স্লোগান নিয়েছেন উমর খালিদরা।
আর ভাসিন এই স্লোগান নিয়েছিলেন আটের দশকে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়ার সময় মহিলাদের একটি মেলা ঘুরে দেখার সময়, যাঁরা প্রতিবাদ দেখাচ্ছিলেন জেনারেল জিয়ার রক্ষণশীল নির্দেশের বিরুদ্ধে।
১৯৮৫, লাহোর স্টেডিয়ামে তৈরি মঞ্চে ধীরে ধীরে উঠে এলেন প্রখ্যাত গজল গায়িকা ইকবাল বানো, যাঁর শৈশব কেটেছে হরিয়ানার রোহতকে। পরনে কালো শাড়ি!
সেদিন মহিলাদের ‘হিন্দুয়ানি পোশাক’ শাড়ি পরা নিষিদ্ধ করেছিলেন জিয়া। নিষিদ্ধ করেছিলেন ফয়েজের গান ও কবিতার চর্চা। সামরিক ফরমানকে উড়িয়ে বছরপঞ্চাশের শিল্পী ইকবাল বানো মঞ্চে উঠলেন সেই শাড়ি পড়ে। এবং কালো শাড়ি পড়ে। ৫০,০০০ দর্শক-শ্রোতার সামনে বানো গাইলেন ‘হম দেখেঙ্গে’। এই গান আসলে সব স্বৈরাচারীর নিশ্চিত পতনের এক সদর্প ঘোষণা। দুনিয়ার সব দেশের শোষিত মানুষের জন্য এক আশা-জাগানিয়া গান। এক প্রত্যয়: আমাদের চোখের সামনেই স্বৈরাচারের পতন ঘটবে। বানো যখন প্রায় স্লোগানের ঢঙে গাইছেন, সব তাজ উছালে জায়েঙ্গে/ সব তখত গিরায়ে জায়েঙ্গে, তখন স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে ওঠে মুহুর্মুহু স্লোগান: ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
হম দেখেঙ্গে, লাজিম হ্যায় কে হম ভি দেখেঙ্গে।
আজকের ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে অত্যন্ত জনপ্রিয় উর্দু ‘নাজম’ বা গীতিকবিতা। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় আইআইটি কানপুর ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ মিছিলে ফয়েজের সেই গীতিকবিতাই গাইছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। আর তা নিয়েই ‘হিন্দুত্বের ভাবাবেগে আঘাত লাগার’ নালিশ ঠুকেছেন আইআইটি কানপুরের এক শিক্ষক।
প্রধান আপত্তি ফয়েজের কবিতার কয়েকটি পংক্তি নিয়ে।
জব আর্জ-এ-খুদা কে কাবে সে/ সব বুত উঠওয়ায়ে জায়েঙ্গে/ হাম আহল-এ-সাফা মারদুদে-এ-হারাম/ মসনদ পে বেঠায়ে জায়েঙ্গে/ স্ব তাজ উছালে জায়েঙ্গে/ সব তখত গিরায়ে জায়েঙ্গে/ বস নাম রহেগা আল্লা কা।
যখন ঈশ্বরের আবাস থেকে/ সমস্ত মিথ্যাচারের বিগ্রহ হটানো হবে/ যখন মসনদে বসানো হবে এই আমাদেরকেই/ এতদিন পবিত্র স্থান থেকে যারা ছিলাম নির্বাসিত/ সব মুকুট ছিটকে পড়বে মাটিতে/ সমস্ত সিংহাসন ভেঙে হবে চুরমার।/ শুধু টিঁকে থাকবে আল্লাহর নাম।
১৯৭৯, নিউ ইয়র্কে বসে নির্বাসিত কবি লিখেছিলেন ‘হম দেখেঙ্গে’ – পরবর্তী চার দশকে যা হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের কন্ঠস্বর। পাকিস্তানে তখন স্বৈরশাসক জিয়া-উল-হকের জমানা। জিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেই ফয়েজ লিখেছিলেন ‘হম দেখেঙ্গে’। লেনিন শান্তি পুরস্কার জয়ী, দু’-দুবার নোবেলের জন্য মনোনীত এই কবি দেখতেন বিপ্লবের স্বপ্ন। জেলও খেটেছেন। স্বৈরাচারীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে শাসকের সিংহাসন-পতনের স্পষ্ট ইঙ্গিত তাই এই কবিতায়।
যে কবি প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের জনক, তার কবিতার ময়না তদন্ত করছে কানপুর আইআইটি। যা দেখে হতবাক, বিস্মিত এবং একইসঙ্গে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানের প্রগতি ভাবনার মানুষও।
উর্দু কবিতা প্রায়শই নিজের কথা সরাসরি বলে না। বলে পরোক্ষে। উর্দু কবিতায় অনুসরণ করা হয় কবিরকে, অনুসরণ করা হয় মহান সেই সব সুফি সন্তদের, যাঁরা বিশ্বভাতৃত্ব ও মানবতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং আক্রমণ করে গিয়েছেন ধর্মীয় চরমপন্থা ও গোঁড়ামিকে। সামগ্রিকভাবে উর্দু কবিতা হল সাধারণ মানুষের দুর্বলতা, তাঁদের প্রতি অবিচার, উৎপীড়ন এবং অমানবিক সামাজিক প্রথা ও ধর্মীর রীতিনীতির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
উর্দু আশারে (দুই চরণে) থাকে অগভীর ভাসা-ভাসা অর্থ। যার আসল অর্থ থেকে যায় গভীরে। প্রকৃত অর্থকে বলা হয় আভাসে-ইঙ্গিতে, উপমা-রূপকের আশ্রয়ে। কবির মূল অভিব্যক্তিকে বুঝতে, আসল স্বাদ পেতে প্রবেশ করতে হয় কবিতার অন্দরে। আর এই আঙ্গিক উর্দু কবিরা তখনই খুব বেশি ব্যবহার করেছেন, যখন সরাসরি মুখ খোলা যাচ্ছে না, যখন দেশে সামরিক শাসন। যেমন কবির লিখেছেন: কাঁকর পাথর জোড়কে মসজিদ লিয়ে বনায়ে/ তা চাড় মুল্লা বাং দে, কেয়া বেহরা হুয়া খুদায়েঁ? ইট ও পাথরে তৈরি মসদিজ/ তার উপর থেকে মোল্লা চেঁচাচ্ছে (আজান)। ঈশ্বর কি বধির হয়ে গেছেন?
ফয়েজও তাঁর কবিতায় সবসময়ই এই ধর্মীয় মেটাফর বা রূপক ব্যবহার করতেন। মুসলিম মৌলবাদের অসহিষ্ণু ধর্মীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর ‘প্রতিবাদী কবিতায়’ ব্যবহার করেছেন ইসলামিক প্রতীককে। যেমন ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতায় ব্যবহার করেছেন। উচ্চাঙ্গের কবিতার মর্ম বুঝতে চলে না এহেন স্থুল সমীকরণ। একমাত্র অসভ্য-বর্বররাই এই বিদ্রূপকে বুঝেও না বোঝার ভান করতে পারেন। এই কবিতায় কবি রূপক হিসেবে কাবা থেকে মূর্তি অপসারণের যে কথা বলেছেন, তা আক্ষরিক অর্থে মূর্তিপূজার বিরোধিতা নয়। জিয়ার উৎখাত হওয়ার অনিবার্যতাকে বোঝাতেই কাবা থেকে মূর্তি সরানোর রূপকটি ব্যবহার করেছেন।
একইসঙ্গে সুফিদের ঈশ্বর-তত্ত্বের মাধ্যমে কবি প্রকারান্তরে মানুষকেই সামনে নিয়ে এসেছেন। প্রথমে বলেছেন, শুধু স্রষ্টার বা আল্লাহর নাম টিকে থাকবে। তারপর ‘আন-আল-হক’ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে ‘স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে’ আমি-তুমিতে বিলীন করে দিয়ে মানবতার কথা বলেছেন। দশম শতাব্দীর ইরানি সুফি সাধক মনসুর হাল্লাজ নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে বলেছিলেন ‘আন-আল-হক’ বা ‘আমিই পরম সত্য’। সুফিবাদ, মরমিবাদে মূল সুর সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে মিলন। বৈষ্ণব মতে তা-ই জীবাত্মা আর পরমাত্মায় মিলন। ফয়েজের গান নিয়ে বিতর্কের পর গীতিকার ও কবি জাভেদ আখতার এর ব্যাখ্যা দিয়ে যেমন বলেছেন, ‘হম দেখেঙ্গে’র এক জায়গায় আছে গুঞ্জেগা আন-আল-হক কা নাড়া। এই আন-আল-হক মানে ‘অহম ব্রহ্ম’, আমিই ব্রহ্ম, যা হিন্দু দর্শনের কথা।
যেমন কবিতার শেষে বলেছেন ফয়েজ:
উঠেগা আন-আল-হক কা নাড়া/ জো ম্যায় ভি হুঁ আওর তুম ভি হুঁ/ আওর রাজ-করেগি খাল্কে খুদা/ জো ম্যায় ভি হুঁ আওর তুম ভি হুঁ।
আওয়াজ উঠবে ‘আমিই তো পরম সত্য’/ যা আমিও বটে, তুমিও বটে।/ আর রাজ করবে গণদেবতা/ যা আমিও বটে, তুমিও বটে।
সারা জীবনে ফয়েজ যা লিখেছেন, সবই মৌলবাদের বিরুদ্ধে, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের চিরকালের নিশানা ছিলেন তিনি। ভারতে যারা স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে, যারা ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারেন না, তারাই একমাত্র ফয়েজকে সাম্প্রদায়িকতার রঙে রাঙাতে চাইছেন।
পাকিস্তানের সামরিক শাসন, মৌলবাদীদের হাতে বারেবারে আক্রান্ত তিনি। লিখেছেন তাই ‘আমার কালি ও কলম/ ওরা কেড়ে নিয়েছ।/ ক্ষতি কি?/ আমার আঙুল আমি ডুবিয়ে নিয়েছি/ আমারই বুকের খুনে।/ আমার মুখে ওরা কুলুপ এঁটেছে/ কি আসে-যায়/ আমার দু’হাতের শিকলই তো/ এখন ঝনঝনিয়ে কথা বলছে।’
১৯৩২, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন ফয়েজ। সেসময় দেখা এম এন রায়, মুজফফর আহমেদের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা সাজ্জাদ জাহিরের (পরে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক) সঙ্গে। যোগাযোগ গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে। কয়েকবছর পরে নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ফয়েজের নিজের কথায়,
১৯৩৫, আমি অমৃতসর কলেজে পড়ানো শুরু করি। কলেজের তরুণ শিক্ষকদের মাঝে এসব বিষয়ে নিয়ে তর্ক হতো। একদিন আমার এক বন্ধু সাহেবজাদা মাহমুদুজ্জাফর আমাকে একটা পাতলা বই দিয়ে বলল, ‘নাও, এটো পড়ো, আগামী সপ্তাহে এটা নিয়ে তোমার সাথে তর্ক হবে। তবে বেআইনি বই, একটু সাবধানে রেখো।’ বইটা ছিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। আমি এক বসাতেই বইটি শেষ করলাম। তারপর আরো তিন-চারবার পড়লাম। মানুষ আর প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ আর সমাজ, সমাজ আর শ্রেণি, শ্রেণি আর উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্টন, উৎপাদন ব্যবস্থা আর উৎপাদন সম্পর্ক আর সমাজ সম্পর্ক, মানব পৃথিবীর মাঝে স্তরে স্তরে সম্পর্ক, বিশ্বাস, চিন্তা আর কাজ– মনে হলো এইসব রহস্য সমাধানের চাবি যেন কেউ হাতে ধরিয়ে দিল। এমনি করে সোশ্যালিজম আর মার্কসবাদ নিয়ে আমার আগ্রহের শুরু।
আগে নয়, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ার সময়ই, কিংবা খানিক পরে তিনি লেখেন: ‘মুঝসে প্যাহলি সি মুহাব্বাত মেরি ম্যাহবুব না মাংগ।’ আগের মতো ভালোবাসা আমার কাছে আর চেয়ো না প্রিয়। তখন যে তাঁর রোমান্স ভাগ হয়ে গিয়েছে বিপ্লবের সঙ্গে।
‘এভাবেই উর্দু কবিতার সুরেলা, মদির মর্জিকে একেবারে পালটে দেন ফয়েজ। কিন্তু কোনও সমীকরণে বাঁধা পড়েননি তিনি। রাজনীতি ও মহৎ শিল্প চেতনার শুভ বিবাহের নাম তাই ফয়েজের কবিতা।’ বলেছেন অমিতাভ দাশগুপ্ত। যেমন দেখেছেন উর্দু ভাষাবিদ ও বিশিষ্ট পণ্ডিত রণেশ দাশগুপ্ত, ‘ফয়েজের কবিতার বিকাশে ঐক্যের স্বতস্ফূর্ততা রয়েছে বলেই এলিয়টের প্রথমদিককার কবিতার মতো ব্যতিক্রমের দামামা ধ্বনি নেই, কিন্তু সাবলীলতায় তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দৃঢ় অতীতে, কোনও চিন্তাচক্রে যাবার সামান্যতম প্রবণতা থেকে। তাঁর দৃষ্টি সামনে, সে দৃষ্টি উদ্ধত না হয়ে পারে না। সে দৃষ্টি অনেক সময় বড় বেশি কোমল, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে ক্ষতি কী? সে তো আত্মসমর্পণ করেনি মায়া মোহের কাছে। ফয়েজের কবিতা সংগ্রামী তৎকালীন বিশ্ব কবিতার সাথে যুক্ত করে দিয়েছে যাকে সমৃদ্ধ করেছেন মায়াকোভস্কি, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, কুয়ো মোজো, পাবলো নেরুদা ও নাজিম হিকমত।’
ফয়েজের নিজের কথায়, ‘সাধারণত বিপ্লবী কবিরা বিপ্লব নিয়ে হাঁকডাক আর ফাঁকা আওয়াজ তোলেন, বুক চাপড়ে হা-হুতাশ করেন। কিন্তু বিপ্লবের গান কিভাবে গাইতে হয়, তা তাদের জানা নেই। তাঁদের মগজে বিপ্লবের আগমনের যে ছবিটি আছে, তার তুলনা কেবল সাইক্লোন, তুফান বা ধ্বংসের দৌড়দৌড়ি। তাতে নেই কোনও সুর, নেই হাজার রঙ-বেরঙের ফুলের বাহার। তাঁরা শুধু বিপ্লবের মারকুটে চেহারাই দেখেন, তার সৌন্দর্যকে দেখেন না বা চেনেন না। বিপ্লব-সম্পর্কে এটা কিন্তু আদৌ প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী নয়।’
পরে ফয়েজ যুক্ত হন ট্রেড ইউনিয়নের কাজে। শ্রমিকদের কাছে এতটাই আপন ছিলেন, একবার বলেছিলেন,
আমাকে চিঠি লিখতে হলে ঠিকানার প্রয়োজন নেই। চিঠির উপরে শুধু লিখে দিও– ফয়েজ, পাকিস্তান। আমি লম্বা সময় পোস্টাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে কাজ করেছি। ওরা আমার মানুষ। ওরা জানে কোন সময় আমায় কোথায় পাওয়া যাবে।
একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে ফয়েজকে। বাধ্য হয়েছেন নির্বাসনে যেতে। রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯৫১-তে গ্রেপ্তারের সময় লন্ডন টাইমস তাঁকে চিহ্নিত করে ‘সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রভাবশালী বামপন্থী’ হিসেবে। চার-বছর বন্দি থেকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে নির্বাসনে যান ইংল্যান্ডে। ১৯৫৮, ফিরে আসার পরে আবার যেতে হয় আয়ুব খানের কারাগারে। এবারে ছ’মাসের জন্য। দু’বছর বাদে মস্কো হয়ে লন্ডনে নির্বাসনে। ছিলেন ১৯৬৪ পর্যন্ত। পরে ১৯৭৯, জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনে আবার নির্বাসনে। এবারে আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধের কেন্দ্র লেবাননে। সম্পাদক হলেন আফ্রো-এশীয় লেখক সঙ্ঘের ‘লোটাস’ পত্রিকার। সরাসরি যুক্ত হলেন পিএলও’র সঙ্গে। নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে। সেসময় ফয়েজের সঙ্গে দেখা এডওয়ার্ড সাঈদের।
বেইরুট ফয়েজের কাছে ছিল ‘হিম্মতের আরশি’।
‘চিরকালের মৃত্যুহীন এই শহর’কে দেখে তিনি লিখেছেন, ‘বেইরুট– / গোটা দুনিয়ার হিম্মতের আরশি।/ বেইরুট–/ পৃথিবীতে বেহেশ্তের গুলবাগিচা।/ রাজপথে গুঁড়ো গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়েছে/ ছেলেমেয়েদের খলখল হাসি।/ চুরমার সব কিছুর ফাঁক-ফোকরে/ উকি মারছে রাতের অন্ধকার।/ বহতা রক্তের আলোয় আরও লাল হয়ে উঠেছে/ বেইরুটের মুখ,/ বেহেশ্তের আলোর চাইতেও লাল,/ সেই আলোয় জ্বলছে সব অলিগলি/ ভিজে যাচ্ছে লেবাননের মাটি।’
এডওয়ার্ড সাঈদের কথায়, ‘ফয়েজকে বুঝতে হলে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। আর তা হলো গার্সিয়া মার্কেজের মতো ফয়েজকেও সাহিত্যের অভিজাত হতে আমজনতা– দুই পক্ষই পড়েছে এবং শুনেছে। তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, বিভিন্ন সুরের মিশ্রণে এমন এক অলঙ্কার ও লয় সৃষ্টি করা, যেখানে তিনি ব্যবহার করেছেন ধ্রুপদী ফর্ম, আবার পাঠকের কাছে সেগুলির রূপ বদলে দিয়েছেন পুরনো ফর্ম থেকে পাঠককে বিচ্ছিন্ন না করেই। যে কোনও ভাষাতেই এমন অর্জন অনন্য– এতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ আপনি এখানে একইসঙ্গে পুরনো এবং নতুনকে শুনতে পাবেন।
ফয়েজের স্পষ্টতা ও শুদ্ধতা বিস্ময়কর। কল্পনা করুন– এমন একজন কবি যার কবিতায় এক হয়ে গিয়েছে ইয়েটসের সংবেদনশীলতা আর নেরুদার শক্তি। আমার মতে, ফয়েজ এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।’
আজীবন কমিউনিস্ট ফয়েজ ছিলেন পাকিস্তানের সেই হাতে-গোনা বুদ্ধিজীবীদের একজন, যিনি বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। বস্তুত, বহু আগে থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানজুড়ে জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তাতে ফয়েজের বক্তব্য যেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার আগাম বার্তা,
‘এই দুই অংশকে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) এক থাকার ব্যাপারে ধর্মকে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এক দেশ হওয়ার জন্য যদি এটাই একমাত্র কারণ হয়, তাহলে এই যুক্তি তো দেওয়া যায়, অন্যান্য মুসলিম দেশও কেন পাকিস্তানে যোগ দিচ্ছে না? আর মুসলিম হয়েও অন্যান্য দেশ যদি আলাদা থাকতে পারে, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান কেন আলাদা হয়ে যাবে না?’
একাত্তরে পাক সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন, হাজার করো মেরে তন মে। আমার শরীর থেকে দূরে থাকো। যে কবিতা বাংলাদেশ-১ নামে পরিচিত। ‘সাজাব তবে কীভাবে সাজাব গণহত্যার শোভাযাত্রা/ আমার রক্তের চিৎকারে আকর্ষণ করব কাকে?’ বাংলাদেশ-২ কবিতায় যেমন লিখেছেন, ‘প্রতিটি গাছ রক্তের মিনারের মতো/ প্রতিটি ফুলও রক্তমাখা/ প্রতিটি চাউনি যেন রক্তের বর্শাফলক।’
এবং ফয়েজের উপর আক্রমণ নতুন নয়।
এই সেদিন ফয়েজ-কন্যা মুনিজাকে আমন্ত্রণ জানিয়েও ফিরিয়ে দিয়েছে দিল্লি। অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশাধিকার দেওয়া দূরের কথা। নির্দিষ্ট হোটেলে পর্যন্ত থাকতে দেয়নি। মে, ২০১৮। নয়াদিল্লিতে ১৫তম এশিয়া মিডিয়া সামিটে আমন্ত্রণ জানানো হয় পাকিস্তানের মিডিয়া ও টিভি ব্যক্তিত্ব মুনিজাকে। উদ্যোক্তা ছিল এশিয়া-প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট ফর ব্রডকাস্টিং ডেভলপমেন্ট (এআইবিডি)। সঙ্গে যুক্ত ছিল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনেশন (আইআইএমসি) এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রক। অনুষ্ঠানের দিন কেন্দ্রের তরফে আয়োজকদের বলা হয়, মুনিজাকে বক্তৃতা করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। এরপর তাঁকে সম্মেলনে নাম নথিভুক্ত করার সুযোগও দেওয়া হয়নি। এমনকি, নির্দিষ্ট হোটেলে থাকার অনুমতি পাননি তিনি। হোটেলে পৌঁছলে মুনিজাকে বলা হয়, তাঁর নামে কোনও ঘর বরাদ্দ নেই। বিকল্প হোটেলের ব্যবস্থা করে পরের দিন সকালে পাকিস্তানে ফিরে যান তিনি।
অন্য একটি গল্প শুনিয়েছেন গীতিকার ও কবি গুলজার।
সেবার বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান ফেরার পথে বিমান কলকাতায় নামলে কলকাতা ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ফয়েজ। এদিকে তাঁর ভিসা নেই। দৃশ্যতই বিব্রত বিমানবন্দরের অফিসার চান মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশ। বসু ওই অফিসারকে বলেন, আপনি পাঁচ-মিনিটের জন্য ওঁর যত্ন নিন, দেখবেন কোনওরকম অসুবিধা যেন না হয়। এবং, পাঁচ-মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দরে বসু। এসে বলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অতিথি।
সেদিন জ্যোতি বসু বলেছিলেন:
‘দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও যেতে ফয়েজের পাসপোর্ট লাগে না। তাঁর মুখই তাঁর পাসপোর্ট।’
মুনিজা অবশ্য মোদী সরকারের এই আচরণের প্রতিক্রিয়ায় ফয়েজের কবিতার একটা পঙক্তি ব্যবহার করেছেন মাত্র। বলেছেন, লম্বি হ্যায় গম কি শাম, মগর শাম হি তো হ্যায়! দীর্ঘ এ দুঃখের রাত, তবু সে তো শুধুই রাত!
প্রভাতের অপেক্ষা।