স্টেট ব্যাঙ্ককে সুইস ব্যাঙ্ক করার চেষ্টা করেছিলেন মোদী।
যারা একদিন সুইস ব্যাঙ্কের তথ্য প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই তারাই স্টেট ব্যাঙ্কের তথ্যকে খামবন্দি করে রাখতে চেয়েছিল। শেষে আর পারেনি। দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কটির নাক কাটা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে।
নির্বাচনী বন্ডকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে এসবিআই-কে তিন-সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তারমধ্যেই নির্বাচন কমিশনকে তুলে দিতে হবে বন্ড-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। ৬ মার্চ ছিল সেই নির্ধারিত দিন। তার ঠিক দু’দিন আগে সুপ্রিম কোর্টে এসবিআই জানায়, ওই দিন সম্ভব নয়, আরও সময় প্রয়োজন। ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানোর আরজি জানায়।
মানে একুশ দিনের পরিবর্তে আরও ১১৬ দিন! ততদিন মিটে যাবে নির্বাচন। হয়ে যাবে নতুন সরকার। দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কটি কাকে আড়াল করতে চেয়েছিল, কিংবা কার নির্দেশে ছিল এই পদক্ষেপ– কারও অজানা নয়। বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের ধমক খেয়ে ‘২৪-ঘণ্টার মধ্যে’ মঙ্গলবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়ার মধ্যেই তা আরও স্পষ্ট। কমিশন তাদের এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছে, তারা এসবিআইয়ের পাঠানো বন্ড সংক্রান্ত নথি পেয়েছে। এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে সেই তথ্য ১৫ মার্চ বিকেল পাঁচটার মধ্যে নিজেদের ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে কমিশনকে। সঙ্গত কারণেই এখন প্রশ্ন, যে তথ্য শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মেনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জমা দিতে পারল এসবিআই, সেই একই তথ্য জমা দিতে ক’দিন আগে তারা কেন চার-মাস সময় চেয়েছিল? বুঝতে অসুবিধে হয় কি নেপথ্যে কার অদৃশ্য হাত!
তার আগে, সোমবার সুপ্রিম কোর্ট তীব্র তিরস্কার করে বলেছে, ‘আমাদের রায় দেওয়া হয়েছিল পনেরো ফেব্রুয়ারি। আজ এগারো মার্চ। এই যে ২৬-দিন চলে গেল, আপনারা কী করছিলেন?’
প্রাক্তন অর্থসচিব সুভাষ চন্দ্র গর্গ, যিনি নির্বাচনী বন্ড চালু করার সময় তার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, সেই তিনি বলেছিলেন: সুপ্রিম কোর্ট যেসব তথ্য চেয়েছে, তার জন্য স্টেট ব্যাঙ্কের ‘একদিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়’। তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, এই তথ্য সহজলভ্য। মাউসে একটা ক্লিক-ই যথেষ্ট। স্টেট ব্যাঙ্ক হয় ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা করছে, নতুবা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়ার জন্য ছ’টি তথ্যের চরিত্র বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই ছ’টি তথ্য হলো: কে বন্ড কিনেছে, কত তারিখে কিনেছে, অর্থের অঙ্ক কত, কোন্ দল তা পেয়েছে, কখন তারা সেগুলি ভাঙিয়েছে এবং তার পরিমাণই বা কত।
তাছাড়া, ২০১৮’র নির্বাচনী বন্ডের নির্দেশিকাতে রয়েছে আদালত চাইলেই এই তথ্য দিতে হবে। প্রাক্তন বিচারপতি দীপক গুপ্তা যেমন নিজেই জানিয়েছিলেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের এমন একটি ডিভিশন বেঞ্চের অংশ ছিলেন, যা ২০১৯ সালে ব্যাঙ্ককে এ ধরনের রেকর্ড রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি সরাসরি বলেছেন, স্টেট ব্যাঙ্কের ব্যাখ্যাকে আমি বিশ্বাস করি না। ওদের অবস্থান রীতিমতো হাস্যকর। তাঁর মতে, এর জন্য বড়জোর লাগতে পারে কয়েক ঘণ্টা, অথবা কয়েকটা দিন।
স্বাভাবিক। বর্তমান ডিজিটাল যুগে সব তথ্যই কম্পিউটারের মাউস ক্লিকের ওপর নির্ভর করে। স্টেট ব্যাঙ্কের সমস্ত কাজও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে হয়। সম্প্রতি তথ্যের অধিকার আইন (আরটিআই)-এ এক প্রশ্নের জবাবে স্টেট ব্যাঙ্ক নিজেই জানিয়েছে, নির্বাচনী বন্ডের তথ্যপ্রযুক্তি পরিকাঠামো গড়ে তুলতে তারা ৬০ লক্ষ ৪৩ হাজার টাকা খরচ করেছে। নির্বাচনী বন্ড বিলি করা, ভাঙানো ইত্যাদির জন্য খরচ করা হয়েছে প্রায় ৮৯ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। নির্বাচনী বন্ড চালুর জন্য মোট খরচ হয়েছে ১,৫০,১৫,৩৩৮ টাকা।
নির্বাচনী বন্ডের তথ্যপ্রযুক্তি পরিকাঠামো গড়ে তুলতে যদি ৬০ লক্ষ টাকার বেশি খরচ করা হয়েই থাকে, তবে স্টেট ব্যাঙ্ক এখন কীভাবে বলছে, সেগুলি মুম্বাইয়ে ব্যাঙ্কের প্রধান শাখায় আলাদা আলাদা মুখবন্ধ খামে রয়েছে!
স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ তাই মোদী সরকারকে হাস্যস্পদ করে তুলেছে। আর যদি এইসব রেকর্ড আলাদা আলাদা মুখবন্ধ খামেও রাখা হয়ে থাকে, তাহলেও ২২,২১৭টি নির্বাচনী বন্ডের হিসাবের জন্য ২১-দিন যথেষ্ট! সেকারণেই শীর্ষ আদালত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তা নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে দিতে বলেছে।
সাধারণ মানুষের কাছে দেশের স্টেট ব্যাঙ্কের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ প্রশ্নের মুখে। স্টেট ব্যাঙ্ককে অবিলম্বে জানাতে হবে কে বন্ড কিনেছে, আর কে সেই বন্ড ভাঙিয়েছে। কোন্ কর্পোরেট সংস্থার বন্ড কোন্ রাজনৈতিক দলের তহবিলে গিয়েছে। ভোটারদের জানা উচিত, যাদেরকে তারা ভোট দিয়েছে, বা দেবে, তাদেরকে কারা টাকা দিয়েছে। নাহলে বোঝাই যাবে না, সেই রাজনৈতিক দলটি বিনিময়ে ওই কর্পোরেট সংস্থাকে কী সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে তাই স্বাগত। কিন্তু এসবিআই-কে এখন জানাতে হবে কে বন্ড কিনেছে, আর কে সেই বন্ড ভাঙিয়েছে। অন্যভাবে বললে কে টাকা দিয়েছে, আর কে সেই টাকা নিয়েছে। বিজেপি কার থেকে কত টাকা নিয়েছে, তা জানা না গেলে বোঝাই যাবে না বিজেপি তাকে সেই অর্থের বিনিময়ে বরাত-সহ কী কী সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনী বন্ড আইনসিদ্ধ করেছিল ধান্দার ধনতন্ত্রকে। পনেরো ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রয়েছে তার স্পষ্ট উল্লেখ: ‘অর্থ ও রাজনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ আঁতাত থাকার কারণে কোনও একটি রাজনৈতিক দলকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার নেপথ্যে কুইড প্রো কুয়ো, অর্থাৎ কোনও কিছুর বিনিময়ে কাউকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার যুক্তিসম্মত সম্ভাবনা রয়েছে।’
আজ সুপ্রিম কোর্ট বলেছে। পাঁচবছর আগে বলেছিল সিপিআই(এম)।
দিল্লিতে পার্টির সদরদপ্তরে (১৫ নভেম্বর, ২০১৮) রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, ‘ধান্দার ধনতন্ত্রকে অবৈধ কাজের সহযোগী করে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি যে আশু লাভ করতে চাইছে, তা হল নির্বাচনে সুবিধার লক্ষ্যে কর্পোরেট অর্থের ঢালাও যোগান। বিজেপির তহবিল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলের মধ্যে বিপুল ফারাকের বিষয়টি এখন স্পষ্ট। নির্বাচনে অর্থ যোগানের লক্ষ্যে যে সংশোধিত আইন, তা নির্বাচনী বন্ডকে করে তুলবে করছাড়ের এক নতুন স্বর্গরাজ্য। এর অতিরিক্ত সুবিধা হল, অনুগ্রহ বিতরণকারী শাসককুলের সঙ্গে তাঁদের নৈকট্য আরও বাড়বে। এবং তাতে শাসকের গৃহীত নীতিগুলিকে প্রভাবিত করে বিপুল পরিমাণ সুযোগ সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে। সেইসব নীতি সাধারণভাবে দেশের স্বার্থের, বিশেষ করে দেশের গরিব ও শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হলেও তা থেকে সুবিধা নিতে পারবে। সেকারণে আমাদের দাবি, রাজনৈতিক দলগুলিকে সীমাহীন এবং বেনামি কর্পোরেট তহবিল যোগানোর ব্যবস্থা এখনই বাতিল ঘোষণা করতে হবে এবং তা করতে হবে নির্বাচনী বন্ড প্রত্যাহার করে নিয়ে।’
নয়া উদারবাদে দুর্নীতির উৎস মুখ হলো বৃহৎ ব্যবসা আর নয়া উদারনৈতিক নীতিসমূহ। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অন্তর্ঘাত চালাচ্ছে অর্থশক্তি আর দুর্নীতি। যেভাবে প্লুটোক্রেসি, অর্থাৎ ধনীদের দ্বারা পরিচালিত সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাত চালাচ্ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। বৃহৎ ব্যবসা ও কোম্পানিগুলি বিপুল অঙ্কের অবৈধ টাকা তৈরি করছে। এবং এই বেআইনি অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করছে। ঘটছে না এর উল্টোটা। পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
১৯৯২-তে, যেদিন ভারতের সবচেয়ে বড় সংস্থা হিসেবে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল রিলায়েন্স, সেদিন চমকে গিয়েছিল সকলে। এর সঙ্গেই দেশ দেখেছে উদারিকরণের বিস্তার। আদানির তাক লাগিয়ে দেওয়া উত্থান। নিউ ইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত হতবাক। বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, এসব দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রবার ব্যারনদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রবার মানে দস্যু!
সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে স্পষ্ট বলেছে, ‘ভোটারদের তথ্য জানার অধিকার গণতন্ত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা করা হয় ভোট অবাধ সুষ্ঠু স্বচ্ছ করতে। সেখানে রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস কী, কে তাদের টাকা জোগান দিচ্ছে, তা সকলের জানার অধিকার রয়েছে। সুষ্ঠু অবাধ ভোটের এটা একটা জরুরি অংশ। তাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।’
সেইসঙ্গেই শীর্ষ আদালত বলেছে, ‘নির্বাচনে রাজনৈতিক দলে কর্পোরেট অর্থদাতা আর ব্যক্তি অর্থদাতা এক নয়। কোনও কর্পোরেট সংস্থার পক্ষ থেকে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলকে অর্থ দেওয়ার মানে এটা একটা ব্যবসায়িক লেনদেন। এই অর্থদানের উদ্দেশ্য অর্থদানের বিনিময়ে কিছু আদায় করে নেওয়া।’
সিপিআই(এম)-ই শুরু থেকেই এর বিরোধিতা জানিয়ে এসেছে। এই অস্বচ্ছ, অসাংবিধানিক বন্ডের মাধ্যমে একটি টাকাও সংগ্রহ করেনি। সংসদের ভিতরে-বাইরে প্রতিবাদের সঙ্গেই গিয়েছে আইনি লড়াইয়ে। শেষে আদালতের রায়।
‘ভোটের পছন্দের বাস্তব অনুশীলনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলির তহবিল-সংক্রান্ত তথ্য অপরিহার্য।’ বলেছেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। আর এই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের এটাই উপযুক্ত সময়। এই নির্বাচনই তার যোগ্য সময়।