ইদানীং জনমনে একটি সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে যে, চলতি লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির যে কেউ যত আসনে জয়লাভ করুক না কেন, সরকার গড়বে সেই দলই যার টাকার থলি সবচেয়ে বেশি মোটা।
সবচেয়ে মোটা টাকার থলিটি কোন দলের সিন্দুকে আছে, সেই গুপ্ত কথা বলে দেওয়ার জন্য অবশ্য কোনও পুরষ্কার দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। সেই টাকা দিয়ে দলটি এমন যথেষ্ট সংখ্যক সাংসদ কিনে নিতে পারবে যাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা যায়। ইদানিং অনেকগুলি রাজ্যে বিধায়ক কেনা-বেচা করে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উলটে ফেলে অন্য আরেকটি সরকার গঠন করার যে কুনাট্য ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, তার ফলেই এই ধারণা জনমনে গেঁথে গিয়েছে।
অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলে রাজনীতির পণ্যায়ন। রাজনীতির এই রকম পণ্যায়নের ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা স্ফীতকায় থলির প্রতি ধাবিত হয়— কোন দলের টিকিটে সেই ব্যক্তিটি নির্বাচনে জিতেছে সেকথা আর বিচার্য বিষয় থাকে না। নির্বাচনে টাকাই আনুগত্যের নির্ধারক, যে নির্বাচকমণ্ডলী বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে ব্যক্তিটিকে ভোট দিয়ে তাকে জিতিয়েছে, সেই প্রশ্ন অবান্তর মাত্র। এমন ঘটনা যে শুধু ভারতেই ঘটছে তা কিন্তু নয়— বহু দেশে টাকার থলিই রাজনৈতিক আনুগত্যকে নির্ধারণ করে।
রাজনীতির পণ্যায়নে নতুন কোনও উপাদান যদি ইদানীংকালে দৃষ্ট হয়, তা হচ্ছে এই যে, নির্বাচনের ফলাফলের এখন যেন আর কোনও মূল্য নেই।
প্রতিটি বস্তু ও পরিষেবাকে পণ্যে পরিণত করার ঝোঁক পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা। ফলে রাজনীতিও যে এই সমাজে পণ্যে পরিণত হবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। জন মেনার্ড কেইন্স-এর সময় থেকে শুরু হওয়া ক্লাসিকাল বুর্জোয়া উদারবাদ দীর্ঘদিন রাজনীতির পরিসরে ক্রিয়াশীল থাকার পরে ‘নতুন’ উদারবাদের জমানায় ঠিক তার উল্টোটা (inversion) আজকাল ঘটছে সব ক্ষেত্রে, এমনকি রাজনীতির পরিসরেও।
কেইন্সের মতবাদ ছিল, অবাধ অর্থনীতির (laissez faire) পুঁজিবাদের বিশেষ ত্রুটি হল শ্রমজীবি জনতার এক বিপুল অংশকে শ্রমের মজুত বাহিনী হিসাবে কর্মহীন ভাবে বসিয়ে রাখা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থনীতিকে এই ত্রুটি থেকে মুক্ত করতে পারে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়িয়ে, সকলের জন্য কাজের ব্যবস্থা করে, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের দ্বারা পুঁজিবাদের একটি মানবিক মুখ জনতার সামনে তুলে ধরা।
এই মতবাদ অবশ্য বেশ কিছুকাল ধরে পিছু হঠেছে। ক্লাসিকাল বুর্জোয়া উদারবাদকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নয়া উদারবাদ। এই মতের প্রবক্তাদের বক্তব্য,: পুঁজিবাদের ত্রুটি খোঁজার কাজে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। কর্মহীনতা বেড়েছে মুক্ত বাজার অর্থনীতির কারণে নয়, বরং রাষ্ট্রই মুক্ত বাজারকে হাজারো নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলে বেঁধে রেখে তাকে স্বাধীনভাবে কাজই করতে দেয়নি। তা যদি দেওয়া হত, তাহলে পুঁজিবাদের তথাকথিত ত্রুটিগুলি অদৃশ্য হয়ে যেত। সুতরাং বাজারকে শৃঙ্খলমুক্ত ভাবে কাজ করতে দেওয়া হোক। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় শুধু নয়, বাজারকে নিয়ন্ত্রণে বেঁধে রেখে তা কেবল পরিস্থিতিকে খারাপ করে তুলেছে।
এই কুযুক্তিকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে ইদানীং অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অবসান ঘটানো হয়েছে। এভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই হয়ে উঠেছে কেইন্সীয় উদারবাদ ও নয়া উদারবাদের প্রস্থান বিন্দু। যাই হোক, রাজনীতির পণ্যায়নের ফলে আমরা ভিন্নতর বিশ্বে উপনীত হয়েছি, যেখানে থলির আয়তন নির্ধারণ করে দেয় কোন্ রাজনৈতিক দল ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাবে। এই নতুন বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুঁজিবাদের ত্রুটি দূর করার বদলে খোদ পুঁজিবাদই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে হীনবল করে তোলে। এই অবস্থায় অর্থ দপ্তরের প্রধান উপদেষ্টা যখন ভরা সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, বেকারত্ব দূর করার জন্য সরকার কিছু করতে পারবে না, তখন বোঝা যায় কেইন্সীয় মতবাদের গঙ্গাযাত্রা ঘটেছে। এখন থেকে বল্গাহীন পুঁজিবাদ আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে, রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তার ফলে যদি লাখ লাখ যুবক বেকারত্বের জ্বালায় ধুঁকতে থাকে, তবে তাই হোক। নয়া উদারবাদের স্পর্ধা এতটাই সীমাহীন যে তাদের জমানায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকারত্বের দুর্দশায় পতিত হচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু করার ভনিতাটুকুও তাদের নেই।
রাজনীতি যখন পণ্যে রূপান্তরিত হয়, তখন শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে রাজনীতিকে সে অস্বীকার (negation) করে। শ্রেণিসংগ্রাম যতই পরোক্ষ অথবা গুপ্ত থাকুক না কেন, রাজনীতি মানেই হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম। পণ্যে পরিণত রাজনীতি এই বুনিয়াদী অর্থটাই পালটে দেয়, মতাদর্শগত রাজনীতিকে এই পণ্যায়িত রাজনীতি পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। পাদপ্রদীপের আলো থেকে মতাদর্শভিত্তিক রাজনীতির অপসারণ ১৯৩০-এর দশকের জার্মানির ফ্যাসিবাদের অন্যতম জন্মচিহ্ন। একই জন্মচিহ্ন দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক নয়া ফ্যসিবাদের অবয়বে। মতাদর্শহীন রাজনীতি তার জন্মচিহ্নযুক্ত যাবতীয় লক্ষণ নিয়ে, জাঁকজমকপূর্ণ আড়ম্বর নিয়ে, যথা, মশাল মিছিলে নেতার জয়গান গাইতে গাইতে পথ পরিক্রমণ, উন্মত্ত জনতার চিৎকৃত জনসমাবেশ, ১৯৩০-এর দশকের জার্মানির মতো ভয় জাগানো প্রতীক ও মূর্তির নবনির্মাণ, কেরালা স্টোরিজ, কাশ্মীর ফাইলস ইত্যাদি বিকৃত তথ্য চিত্র — যেমন লেনি রাইফেন্সটাল (Leni Riefenstahl) সেই সময়কার জার্মানিতে বানিয়েছিল, প্রায় অবিকল সবকিছুই আবার বর্তমান ভারতে হাজির হয়েছে।
জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন এই জাঁকজমকপূর্ণ আড়ম্বরকে রাজনৈতিক পণ্য হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তফাৎ শুধু এই যে, যে কোনও পণ্যের একটা ব্যবহার মূল্য থাকে, কিন্তু এক্ষেত্রে এই রকম জাঁকজমকের আড়ম্বরই সার, কোনও মূল্য নেই। কিন্তু যত মিলই উভয় ফ্যসিবাদের মধ্যে থাক না কেন, ফ্যসিবাদি জার্মানির সঙ্গে ভারতের নয়া ফ্যাসিবাদের জমানার একটা তফাৎ অবশ্যই আছে— এখানে পণ্যে পরবর্তিত রাজনীতির জাঁকজমক শুধু নেই, তদুপরি আছে কিছু মিথ্যার বেসাতি, কিছু বিকৃত ভাষ্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আছে কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, আর তাদের নিজেদের বিক্রি করার আদিম আকাঙ্খা।
কারও কারও মনে হতে পারে যে, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদকে মতাদর্শ বিচ্যুত (de-ideolizing) রাজনীতি বলা চলে না। এই রাজনীতি জনতার মনে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের বিষ ছড়িয়ে দেয়। যতই বিষাক্ত হোক না কেন, অন্যান্য মতাদর্শের মত সাম্প্রদায়িকতাও একটি মতাদর্শ। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। যে কোনও ফ্যাসিষ্ট ‘মতাদর্শ’-এর মতো সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ ততটাই মতাদর্শ-বিচ্যুত (de-ideolizing) রাজনীতি, যেমন ছিল জার্মানির নাৎসি ‘মতাদর্শ। তাছাড়া, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পণ্য হিসাবে যখন খুশি কিনে নেওয়ার মধ্যে যে অনুক্ত কথাটি লুকিয়ে থাকে তা হল এই যে, ক্রেতা দলটিও আশা করে এই রকম বেচা-কেনার ঘটনাকে খোদ নির্বাচকমণ্ডলীও রুটিন ঘটনা বলে পরোক্ষে মেনে নেবে। ক্রেতা এবং বিক্রি হয়ে যাওয়া জনপ্রতিনিধি উভয়েই এমনটা আশা করে। এই ঘটনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়রূপে কর্তৃত্বকারী ভূমিকা থেকে জনগণকে হঠিয়ে তাদেরকে নেহাতই মতামতহীন অবজেক্ট-এর পর্যায়ে অবনমিত করে।
সুতরাং রাজনীতিকে পণ্যে পরিবর্তিত করার প্রক্রিয়ায় এটা ধরে নেওয়া হয় যে কর্তৃত্বের স্থান থেকে চ্যুত হয়ে ব্যক্তিমানুষ কলের পুতুলের মত বস্তুতে পরিণত হয়েছে, তাদের নিজস্ব ভাবনা চিন্তার পরিসরকে রুদ্ধ ক’রে দেওয়া হয়েছে শুধু নয়, তাদেরকে অবমানবের পর্যায়ে অধঃপতিত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ম্যানিপুলেট করা যায়। এই ম্যানিপিউলেশনের একটি উপাদান হল একদল হতভাগ্য সংখ্যালঘুকে ‘অপর’ হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে বহু শতক আগে তাদের কল্পিত পূর্বপুরুষের কৃত ‘অপরাধের’ জন্য এখন তাদের শাস্তি দেওয়া। এবং অন্য উপাদান হল জনগণের মনে ধীরে ধীরে জনপ্রতিনিধি কেনা-বেচার ঘটনার প্রতি পরোক্ষ সম্মতি অথবা উদাসীনতার মনোভাব অনুপ্রবেশ করানো। রাজনীতির পণ্যায়ন নিশ্চিত করার জন্য জনমতকে এভাবে ম্যানিপুলেট করাটা প্রয়োজনীয়। রাজনীতিকে পণ্যে রূপান্তরিত করার জন্য নিপীড়নের বহুল ব্যবহারও পরিপূরকের কাজ করে।
পণ্যায়ন কখনই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ঘটে না। উপনিবেশিক ভারতে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এক ধরণের কর ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছিল। এর মোদ্দা কথাটা হল, মহাজনের থেকে ঋণ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ফসল কৃষক যাতে তার জমিতে উৎপাদন করে এবং মহাজন অথবা ব্যবসায়ীদের কাছে পূর্বে করা চুক্তিমতো দামে যাতে বিক্রি করে, সেজন্য কৃষকের ওপরে নির্যাতন চালানো। একে বাধ্যতামূলক পণ্যায়ন বলা যেতে পারে। পণ্যায়নের বিরুদ্ধ স্বর সব সময়েই বর্তমান ছিল এবং অবধারিতভাবেই তাকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হত। নয়া ফ্যাসিবাদি জমানায় যখন রাজনীতিকে পণ্যে রূপান্তরিত করা হয় তখনও যে বিরুদ্ধ স্বর দমন করার জন্য বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেওয়া হবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তবুও রাজনীতির পণ্যায়ন ও বিপণনের বিরোধিতা করতেই হবে। কিন্তু এই বিরোধিতা তখনই অর্থবহ হবে যখন মতাদর্শগত রাজনীতির পুনর্জাগরণ সারা দেশ জুড়ে বিস্তার লাভ করবে।