কেউ কেউ বলেন পরিবেশ আন্দোলনের কোনও রাজনীতি নেই। কোনও একটি দেশের বামপন্থী দল নয়, আগামী প্রজন্মের জলবায়ু কর্মীদের সংগঠন ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’-এর ওয়েব সাইটে গত বছর বলা হয় যে জলবায়ু সংগ্রাম (climate struggle) হল শ্রেণি সংগ্রাম। এখানে আরও বলা হয় যে, বছরের পর বছর ধরে শাসক শ্রেণি, মূলত ধনী, শ্বেতাঙ্গ, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলত উত্তর গোলার্ধের কর্পোরেট সংস্থা এবং সরকারগুলির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছে। এই ক্ষমতা তারা উপনিবেশবাদ এবং পুঁজিবাদী শোষণের মাধ্যমে অর্জন করেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ এবং ‘অর্থনৈতিক বৃদ্ধি’ কে চিরস্থায়ী করতে দক্ষিণ গোলার্ধের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রগুলি এবং সেগুলির উপর নির্ভরশীল জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এই ব্যবস্থার আর এক বিশেষত্ব হল যে, এই বিধ্বংসী ব্যবস্থা গড়ে তোলার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় যে শ্রমজীবী মানুষকে তারাই এই বাস্তুতন্ত্রগুলির উপর জীবন ও জীবিকার জন্য নির্ভরশীল। ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আরও বলছে যে, পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ পুঁজিপতি মুনাফার লোভে পরিবেশ ধ্বংসের খেলায় মেতেছে। তাদের মুনাফা হল আমাদের যন্ত্রণা এবং মৃত্যু।
বিগত ৫ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ক্লাইমেট স্ট্রাইকের ডাক দিচ্ছে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় শুক্রবার এই ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এবছরও ১৫ই সেপ্টেম্বর ছিল ধর্মঘটের দিন। এবারের স্লোগান ছিল, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাও। অবশ্য কেবল ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ নয়, কিশোর ও যুবকদের এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের অসংখ্য সংগঠন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তথাকথিত ‘মূলস্রোতের’ সংবাদমাধ্যমগুলি এই আন্দোলনের খবর প্রচার করতে নারাজ। পশ্চিম বাংলায় বিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’ ৫ বছর ধরে এই আন্দোলনের শরিক। বিশ্বজুড়ে কতটা ছড়িয়েছে এই আন্দোলন? ইউরোনিউজের দেওয়া খবরে বলা হয় যে, এ বছরের গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইকের ৫ম বর্ষে প্রায় ১৫৯ টি দেশের পরিবেশ কর্মীরা যুক্ত হয়েছেন। আগামী বছরের পরিকল্পনা হল, বিশ্বের ৩৮০০ টি শহরে এই কর্মসুচি পালিত হবে। কেবল পশ্চিম বাংলাতেই ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রায় ৭৫০টি স্থানে মূলত আগামী প্রজন্মের পরিবেশ কর্মীরা প্রতিবাদে সরব হন। ইউরোপের জলবায়ু গবেষকদের মতে এবছর আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিবাদীদের সমাবেশ ঘটেছিল। The NARWHAL ওয়েব ম্যাগাজিন লিখছে, ৫টি মহাদেশের প্রায় ৬৫টি দেশের ৫০০-র ও বেশি শহরের হাজার হাজার প্রতিবাদী এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সংবাদ সংস্থা AP জানাচ্ছে যে, ইউরোপ থেকে আফ্রিকা হয়ে দক্ষিণ পুর্ব এশিয়া পর্যন্ত হাজার হাজার যুবক যুবতী পথে নামেন ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ সহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে। ফিলিপাইনসের কুইজন সহরে জলবায়ু কর্মীরা দেশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগের সামনে শুয়ে থেকে প্রতিবাদ জানান। সুইডেনে জলবায়ু কর্মীরা রাজপ্রাসাদ এবং সংসদের সামনে জড়ো হয়ে ‘Climate Justice’ বা ‘জলবায়ু ন্যায়বিচার’- এর দাবি জানান।
রাজনীতির ভাষা
২০২২ সালে জলবায়ু ধর্মঘটের স্লোগান ছিল ‘People not Profit’। অর্থাৎ মুনাফা নয়, মানুষই শেষ কথা। ২০২১ সালে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’-এর আহ্বান ছিল ‘জলবায়ু নয়, ব্যবস্থার পরিবর্তন কর’। যে পুঁজিবাদী কর্পোরেটকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা ছিল এই আহ্বানে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্রিন দলগুলির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ খুবই স্পষ্ট। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU)-এর পার্লামেন্টে এদের প্রতিনিধিত্ব চোখে পড়ার মত। ইইউ-র একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ জার্মানিতে গ্রিন পার্টি (Die Grune) এখন ক্ষমতার এক বড় অংশ। জার্মানির গ্রিন পার্টির নেতাদের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বোঝা যায় যে, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এদের জোরালো বক্তব্য থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে, বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনই যে একমাত্র পথ— তা তারা স্বীকার করেনা। এমন একটা অবস্থায় নবীন প্রজন্মের সামনে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’-এর শ্রেণি আন্দোলন এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানের ডাক এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছে।
কেন এই ধর্মঘট
সুইডেনের তরুণী গ্রেটা থুনবার্গ বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতি শুক্রবার স্টকহোমে সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সরকারগুলির নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ করতে করতে বিশ্বের অন্যতম প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সভায় (পোল্যান্ডের কার্টওয়াইস শহরে অনুষ্ঠিত) বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সামনে গ্রেটার দাবি ছিল বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এই সময় থেকেই শুরু হয় ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’। ইউএনইপি (United Nations Environment Programme) বলছে যে, এই আন্দোলন সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের সামনে এক অনুপ্রেরণা।
জলবায়ু পরিবর্তনে উত্তর-দক্ষিণের বৈষম্য স্পষ্ট। ১৯৯৭ সালে কিয়োটো চুক্তির সিদ্ধান্ত মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিকে (Annex-1 countries) বর্তমানের নির্গমন কমানোর উপর জোর দিতে বলা হয়। কিয়োটো চুক্তি অনুযায়ী যে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় তাতে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইজরায়েল সহ মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ সাড়া দেয়নি। ফলে পৃথিবীর কার্বন স্পেস (carbon space) উন্নত দেশগুলির দ্বারাই পুরণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে এই দাবি তুলতে না পারলে সর্বনাশ আসন্ন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমেরিকা এপর্যন্ত বায়ু মণ্ডলে ৪০ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড বা তার সমতুল্য গ্যাস জমা করেছে। ভারতবর্ষে এই পরিমাণ ৫ কোটি টনেরও কম। বর্তমানে বছরে আমেরিকার মাথাপিছু নির্গমন প্রায় ১৬ টন। অথচ ভারতে মাথাপিছু নির্গমন ১ থেকে ১.৫ টন।
২০১৫ সালে UNFCC-র চুক্তির (COP24) প্রাক্বালে প্রত্যেকটি দেশকে তাদের দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য নিজেদের ঘোষণাপত্র (Intended Nationally Determined Contribution) দিতে বলা হয়। সেই মতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ১৯০টি দেশ এব্যাপারে নিজস্ব অঙ্গীকার জমা দেয়। কিন্তু এই অঙ্গীকারগুলি মেনে চলার কোনও লক্ষণ IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change)-র ২০২১ এবং ২০২২ সালের ষষ্ঠ রিপোর্টের সংগৃহীত তথ্যে প্রতিফলিত হয়নি। ট্রাম্প আমলের আমেরিকা এই চুক্তিকে অস্বীকার করে। বিভিন্ন দেশের সরকারের অনীহা এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে এই চুক্তি অর্থহীন হয়ে যায়। অতি সম্প্রতি আরও একটি আইএনডিসি জমা পড়েছে। এটিতে সরকারের অনেক বড় বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০১৮ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবহিত করতে আইপিসিসি একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় যে, যে ভাবেই হোক না কেন প্রত্যেকটি দেশের রাষ্ট্রনেতাদের যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত না রাখতে পারলে সমূহ বিপদ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, এই ভাবে চলতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেক বেশী হবে এবং উত্তর মেরুতে এক টুকরো বরফও থাকবে না। আজকে যে শিশু জন্মাবে সে যে পৃথিবী দেখবে তাতে সমুদ্রতলের উচ্চতা ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে। ভারতের কলকাতা সহ সমুদ্রের কাছাকাছি আরও কিছু শহর সমুদ্রের তলায় চলে যাবে।
সর্বনাশা বাণিজ্যের নূতন রূপ
একটি দেশে শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ তার উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। শক্তি উৎপাদনের উৎস হল প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার। শক্তি উৎপাদনের সময় জ্বালানি ব্যবহার হলে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়। উন্নয়নশীল দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির উৎসের উপর অধিক নির্ভরশীলতাই বাস্তব। ঐতিহাসিক কার্বন নির্গমন (historic emission)-এর তথ্য বলছে যে, শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই আজকের দুনিয়ার উন্নত দেশগুলি খনিজ জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার করে এই গ্রহের কার্বন স্পেসের অধিকাংশটাই দখল করে নিয়েছে। এটা ঠিক যে, সে সময়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে ধারনা এবং সচেতনতা দানা বাঁধেনি। কার্বন স্পেস মানে সর্বাধিক যতটা কার্বন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধারণ করলে জীবকুল বাঁচতে পারবে। কার্বন স্পেস এর অধিকার থেকেই শুরু বিশ্ব পরিবেশ রাজনীতি। দক্ষিণের দেশগুলি বা উন্নয়নশীল দেশগুলি যে লড়াই ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আমেরিকা, চিন ইত্যাদির নেতৃত্বে করতে পারত তা করতে অপারগ হয়েছে। ফলে উন্নত দেশগুলি কার্বন স্পেস এর উপর তাদের প্রভুত্ব সমানে বজায় রেখেছে।
কোন একটি দেশে কার্বন নির্গমনের আধিক্যের কারণে সেই দেশ তার উৎপাদক সংস্থাকে কার্বন শোষণের ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলি সাধারণ ভাবে কার্বন শোষণের ব্যবস্থার দায়িত্ব না নিয়ে বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা কার্বন বিক্রি করে দিতে চায়। কার্বন শোষণের সবচেয়ে সস্তা এবং সহজ উপায় হল অরণ্য সংরক্ষণ এবং নিদেনপক্ষে বৃক্ষ রোপণ। কিন্তু এর জন্য চাই জমি। উন্নয়নশীল দেশে যদি সরকার কর্পোরেট-বান্ধব হয় তাহলে তো কথাই নেই। জমি অধিগ্রহণের পরিবর্তে কার্বন অফসেট (offset) বা ক্ষতিপূরণ বাণিজ্যিকভাবে সহজ পদ্ধতি। একটি দেশের পণ্য উৎপাদনকারী কোনও কর্পোরেট সংস্থা অন্য একটি দেশের বা সেই দেশের অন্য কোনও স্থানে অরণ্য সৃজন বা প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া অরণ্য (degraded forest) সংরক্ষণের জন্য কার্বন বিক্রি করতে পারে। একেই কার্বন অফসেট বলা হয়। এই দেওয়া-নেওয়া ঘটে অর্থের বিনিময়ে এবং এই বিনিময়কে কার্বন বাণিজ্য (carbon trading) বলা হয়। আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন চুক্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কার্বন বাণিজ্যের ব্যবস্থাপনাকে আরও সুদৃঢ করার পরিকল্পনা পাকা করা হয়েছে। REDD+ (Reducing Emissions from Deforestation and Forest Degradation) নামে চুক্তি এবং তার সাথে অরণ্যের সংরক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে শংসাপত্র দেওয়ার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা (certification mechanism) তৈরি করা হচ্ছে। আসলে এ হল আন্তর্জাতিক ভাবে অরণ্য পরিচালন নিয়ন্ত্রণের অন্য এক নাম। ভারতের মতো একটি দেশ, যেখানে শিল্প উৎপাদন অনেকটা কম এবং ২৩ ভাগ অরণ্য ও বেশ কিছু পতিত জমি রয়েছে, সেখানে কার্বন শোষণের জন্য ব্যবস্থা তৈরি করা হল কার্বন বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। কার্বন বাণিজ্যের ব্যবস্থাপনাকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা উইন-উইন অবস্থা বা উভয়পক্ষের জন্য কল্যাণকর বলে অভিহিত করে থাকে। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, এখানে চরম বিপদের মুখে চলে যায় অরণ্য ও অরণ্যবাসীরা। বলাই বাহুল্য, এই ব্যবস্থার মধ্যে বনবাসীরা সম্পূর্ণ ভাবে ব্রাত্য। এমনকি এই ব্যবস্থায় আমাদের দেশের অরণ্য পরিচালনের ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্য সরকারগুলিরও অংশগ্রহণের খুব কম সুযোগ থাকবে।