জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, যিনি নিজেই ফ্যাসিবাদের নিপীড়ন সহ্য করেছেন, তিনি মনে করতেন যে ফ্যাসিবাদের অব্যবহিত পূর্বে সংগঠিত সর্বহারার বিপ্লব প্রচেষ্টাগুলির ব্যর্থতার সঙ্গে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণগুলি সম্পর্কিত রয়েছে। তার এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গীর পেছনে অবশ্য জার্মানীর ঘটনাবলী কাজ করেছিল। বলশেভিক বিপ্লবের ঠিক পরে পরেই সেই সময়কার জার্মানীতে অনুরূপ বিপ্লব সংঘঠিত করার বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই বিপ্লবী উদ্যোগগুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার ফলে সর্বহারা মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং তাদের আনুগত্য কমিউনিষ্ট পার্টি এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে বিভাজিত হয়ে পড়েছিল। সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের সরকার শাসনক্ষমতায় থাকাকালীন রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল লিবনেখ্ট এবং আরও অনেক কমরেডদের হত্যাকান্ড ঘটার কারণে উভয় দলের মধ্যে অমীমাংসেয় তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকে যখন দুনিয়া জুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা আছড়ে পড়েছিল, তখন এইসব কারণের ফলে সর্বহারাদের হতাশার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতা দখল করল। এই কাজে তাদের মদত দিল একচেটিয়া পুঁজি, বিশেষত ইতিমধ্যে পুঁজির বাজারে সদ্য উত্থিত একচেটিয়া পুঁজির সবচেয়ে নীতিহীন অংশটি।
বেঞ্জামিনের তাত্ত্বিক প্রস্তাবনার গুরুত্ব হচ্ছে এটাই যে তিনি ফ্যাসিবাদের উত্থানকে দেখেছিলেন ক্রমশ অগ্রসরমান সর্বহারার প্রতিস্পর্ধী হিসাবে নয়, বরং সেই সর্বহারার বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে যে সর্বহারা নিজের ওপরে আস্থা হারিয়ে ক্রমশ হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। যে অর্থনৈতিক সংকটের ফলে শ্রমিকরা ব্যাপক হারে কর্মহীন হয়ে পড়ছিল এবং ক্রমশ আরও বেশি দুর্দশায় পতিত হচ্ছিল, তেমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সর্বহারা যাতে পুনরায় ফের সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, সেরকম ঘটনা প্রতিহত করার জন্যই ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল।
ভারত থেকে শুরু ক’রে হাঙ্গেরি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে সম্প্রতি যেরকম নয়াফ্যাসিবাদী উত্থান প্রত্যক্ষ হচ্ছে, তা কিন্তু সেইসব দেশে বেঞ্জামিন কথিত কোনো ব্যর্থ সর্বহারা বিপ্লবের কারণে ঘটছে না। তৎসত্ত্বেও বেঞ্জামিন যেমন উল্লেখ করেছিলেন, শ্রমিকশ্রেণির ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া, সেই শর্তটি বর্তমান পরিস্থিতিতেও যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে। যদিও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিকশ্রেণির ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ার বিষয়টি নিহিত রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নতর কারণের (factor) ওপরে। সেই ফ্যক্টরটি হ’ল নয়া উদারনীতিবাদের জমানায় পুঁজির ক্রিয়াকলাপ।
২
অন্তত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে নয়া উদারবাদ শ্রমিকশ্রেণির শক্তি ও সামর্থ্যকে দুর্বল ক’রে তোলে। প্রথমত,শ্রমিক শ্রেণি যখন নিজ নিজ দেশের সীমানার মধ্যে এখনো সংগঠিত হয়, পুঁজি তখন নিজ নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ক্রমশ আন্তর্জাতিক চরিত্র অর্জন করেছে। সুতরাং অবস্থাটা বর্তমানে এইরকম দাঁড়িয়েছে যে এক দেশের শ্রমিক শ্রেণি মুখোমুখি হচ্ছে আন্তর্জাতিক চরিত্রের পুঁজির। এর ফলে দেশীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ সংগঠনের শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা পুজিকে আঘাত করার ক্ষমতা অথবা তার সাথে দর কষাকষির ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রদর্শনের শক্তি হারিয়ে ফেলছে। শ্রমিক যদি পুঁজি বিরোধী সংগ্রামে জঙ্গীপনা দেখায়, তাহলে পুঁজি তার উৎপাদন ক্ষেত্র অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার পালটা হুশিয়ারি দেয় যার ফলে শ্রমিক শ্রেণি পুঁজি বিরোধী লড়াই একটা সীমার মধ্যে গন্ডিবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিট্স দেখিয়েছেন যে ২০১১ সালে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে একজন পুরুষ শ্রমিকের গড় প্রকৃত মজুরি ১৯৬৮ সালের গড় প্রকৃত মজুরির থেকে সামান্য কম! এই উদাহরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আন্তর্জাতিক পুঁজির হামলার মুখে শ্রমিক শ্রেণির আঘাত করার ক্ষমতা কতটা হ্রাস পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পুঁজির হামলার মুখে, বরং বিশেষ ক’রে পুঁজির সংকটের সময়ে কর্মহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এতটাই যে শ্রমের মজুত বাহিনীর আপেক্ষিক আয়তন বেড়ে গিয়েছে লক্ষ্যণীয় ভাবে। ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া পুঁজিবাদী সংকটের সময়ে বেকারত্ব বেড়েছে তো বটেই, এমনকি সংকট শুরু হওয়ার আগেও যখন সস্তা শ্রমের খোঁজে মেট্রোপোলিস (অর্থাৎ উন্নত পাশ্চাত্যের দেশগুলি) থেকে পুঁজি যখন দক্ষিণ গোলার্ধের সস্তা শ্রমের দেশগুলিতে তাদের উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছিল, তখন উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হ’তে লাগলো। অথচ বিনিময়ে দক্ষিণ গোলার্ধে সমপরিমাণ কাজের সুযোগ সৃষ্টি হ’ল না। কারণ ততদিনে নয়া উদারবাদের হামলার কারণে ক্ষুদ্র উৎপাদকদের , বিশেষত কৃষক চালিত কৃষিক্ষেত্র থেকে জমি থেকে উৎখাত হয়ে দলে দলে শ্রমজীবী মানুষ শহরগুলিতে ভিড় জমাতে শুরু করেছে কাজের খোঁজে। কিন্তু সেখানেও নতুন কাজের আকাল দেখা দিল কারণ বাণিজ্যক্ষেত্রের উদারীকরণের দরুণ যে গলাকাটা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হ’ল ,সেখানে টিঁকে থাকতে গেলে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগের হার ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে হবে যাতে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার হার নাগাড়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে (যা নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টির স্বাভাবিক হারকে ছাপিয়ে যায়)। এসব ঘটনার নিট ফল হ’ল সংকটের আগে থেকেই কী উত্তর দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত সব দেশেই শ্রমের মজুত বাহিনীর আপেক্ষিক আয়তন বৃদ্ধি পায় এবং এর অব্যবহিত ফলস্বরূপ শ্রমিক শ্রেণি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
তৃতীয় যে কারণের ফলে শ্রমিক শ্রেণি দুর্বল হয়ে পড়ে তা হচ্ছে নয়া উদারবাদের জমানায় রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের ক্রমাগত বেসরকারিকরণ। সারা দুনিয়া জুড়েই দেখা গেছে যে বেসরকারি ক্ষেত্রের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা অধিকতর সংগঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গিয়েছে যে সেখানকার বেসরকারি ক্ষেত্রের মাত্র ৭ শতাংশ শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত, তার তুলনায় (শিক্ষাক্ষেত্র সহ) রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কর্মচারীদের ৩৩ শতাংশ ইউনিয়নভুক্ত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারীকরণের ফলে শ্রমিকদের সাংগঠনিক শক্তি হ্রাস পায়। বেসরকারিকরণের এই কুফলটি পন্ডিতদের চর্চায় খুব কমই উঠে আসে। বিশেষত ভারতের মত প্রান্তিক দেশগুলিতে বেসরকারিকরণের কারণে নিত্য নতুন আবিষ্কারের গতি যে স্তিমিত হয়ে আসে এবং অর্থনীতি স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠার বদলে যে ক্রমশ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে, পন্ডিত মহলে এসব কথা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলে, কিন্তু তার সাথে সাথে যে শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যঘাতের ক্ষমতারও হ্রাস ঘটে, এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি অনুক্ত থেকে যায়।
একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যাঘাতের ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে তারা আর বিশেষ কোন অস্থায়ী দাবী আদায়ের জন্য দেশজোড়া সুবৃহৎ এবং চোখধাঁধানো সমাবেশ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এইরূপ উৎসাহসঞ্চারকারী বহু সমাবেশ বিগত বছরগুলিতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের মত দেশজোড়া রেলওয়ে ধর্মঘট অথবা তার পূর্বে লোকো মেন্স স্ট্রাইকের মত কিংবদন্তী লড়াইয়ের রূপকথার পুনরাভিনয় বর্তমানে শিল্পের বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে অথবা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির উন্নতিকল্পে দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মত দৃঢ় এবং নাছোড়বান্দা সংগঠন-শক্তিকে জমায়েত করা বর্তমান পরিস্থিতিতে সত্যিই দুরূহ।
৩
অতএব দেখা যাচ্ছে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেকার জার্মানিতে একের পর এক বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ঘটনাবলীকে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ হিসাবে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যে প্রমাণ পেশ করেছিলেন, বর্তমান দুনিয়ায় তা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে নয়া উদারবাদের দুনিয়া জোড়া বিস্তারের ঘটনাটাই ফ্যাসিবাদ আধুনিক রূপে উত্থিত হয়েছে। অবশ্য শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যাঘাতের শক্তি হ্রাসের ঘটনা আজকের দিনের ফ্যাসিবাদের উত্থানের একমাত্র কারণ নয়। নয়া উদারবাদ অবধারিত ভাবে যে অমোচনীয় সংকট ডেকে আনে এবং তার ফলে শ্রমিক শ্রেণির সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়াটা ফ্যাসিবাদের উত্থানের অনুঘটকের কাজ করে।বুর্জোয়া উদার মতবাদ নয়া উদারবাদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের এই সম্পর্ক-সূত্রকে বুঝতে পারে না প্রথমত এই কারণে যে তারা সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি বিভাজনকে অস্বীকার ক’রে সমাজকে ব্যক্তির সমষ্টি অথবা অ-শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিসমূহের গোষ্ঠি হিসাবে দেখে এবং নয়া উদারবাদকে এমন কিছু দুষণীয় ব্যাপার ব’লে মনে করেনা, বরং তাকে সমর্থনই করে। ফলে দুনিয়া জুড়ে একই সঙ্গে এতগুলি দেশে নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান কেন হ’ল এই ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করার মত কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। কেন হঠাৎ একই সঙ্গে ট্রাম্প, মোদি, বোলসোনারো,মাইলিস,মেলোনিসদের দিকে দিকে একই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উত্থান হ’তে লাগলো? তাদের এইভাবে একই সঙ্গে উত্থানের পেছনে পেছনে দুনিয়াজুড়ে ঘটে চলা অনুরূপ সংকটকালের প্ররোচনা রয়েছে এবং এই আন্তর্জাতিক একইরকমের সঙ্কট কাল একমাত্র নয়া উদারবাদের অর্থ নৈতিক সংকটের কানাগলিতে এসে আটকে যাওয়া ছাড়া আর কিছু হ’তে পারে না। হায় ! এইসময়ে শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যাঘাতের ক্ষমতা নয়া উদারবাদ আগেই কেড়ে নিয়েছে। এই সব রাষ্ট্রনেতারা নিজ নিজ দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ যাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে পারে এমন সংখ্যালঘু একটি অংশকে বেছে নিয়ে তাদের ‘অপর’ ব’লে চিহ্নিত করে দাগিয়ে দেয় যাতে নয়া উদারবাদ সৃষ্ট যাবতীয় অর্থনৈতিক দুর্দশার মূলে তারাই দায়ী ব’লে অভিযোগ তোলে। এখান থেকে শুরু হওয়া অভি্যোগের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হ’তে থাকে যাতে প্রত্যাহিক যাবতীয় দুর্দশার মূলে নয়া উদারবাদী শোষণের আসল কারণটি থেকে জনতার দৃষ্টি ঘুরিয়ে এই কল্পিত ‘অপর’-এর প্রতি সব না-পাওয়ার বেদনাকে বিদ্বেষে রূপান্তরিত করে, তাকে আক্রমণ করে ।
৪
উপরের আলোচনা থেকে এক গুচ্ছ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। প্রথমত, গণতন্ত্রকে রক্ষা করা ও তাকে বিকশিত করার জন্য শ্রমিক শ্রেণির শক্তিশালী সংগঠনের অস্তিত্ব থাকা যে একান্তই প্রয়োজন, এই কথা বুর্জোয়া উদারবাদী মতামতের সম্পূর্ণ বিরোধী, বরং তারা শ্রমিকদের শক্তিশালী সংগঠন থাকাটা এই কারণে বিরোধিতা করে যে তাহ’লে শ্রমিকরা ধর্মঘট ইত্যাদির দ্বারা ‘গোটা সমাজকে পণবন্দী’ ক’রে ফেলবে। এই মনোভাব শ্রমজীবী জনতাকে কেবল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মত অনৈতিক ও বস্তাপচা ধারণা মাত্র নয়, সামাজিক প্রক্রিয়াকে বোঝার মত ন্যূনতম জ্ঞান্টুকুও এই মতের প্রবক্তাদের নেই। বস্তুত, যে স্বাধীনতা শ্রমিকশ্রেণি কেবলমাত্র শ্রেণি হিসাবে নয়, বরং দেশের সমস্ত নাগরিকদের অংশ হিসাবে যে স্বাধীনতা এখনো ভোগ করে তার কারণ হচ্ছে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও জনগণের বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসনের মুখে শ্রমজীবী শ্রেণিগুলি এখনো পর্যন্ত বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের ফ্যসিবিরোধী কার্যক্রমের দ্বারাই। শ্রমিকদের ট্রেডইউনিয়ন অধিকার ও নাগরিকদের ব্যক্তি অধিকারের মধ্যেযে দুস্তর পার্থক্য আছে ব’লে লিবারেল মতবাদীরা যে যুক্তি খাড়া করে, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংকুচিত হ’লেও ব্যক্তি অধিকার অটুট থাকতে পারে ব’লে তারা যেরকম মনে করে, তা যে একেবারেই ভ্রান্ত সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হল, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের অস্তিত্ব গণতন্ত্রের পক্ষে অপরিহার্য। এখানেও উদারপন্থী বুর্জোয়া মতবাদীদের ধারণা বিপরীতমুখী। তারা ভাবে যে উদারবাদী গণতন্ত্র এবং বেসরকারী উদ্যোগ পরস্পরের পরিপূরক। এমন কোন অর্থনীতির কথা যদি বিবেচনা করা যায় যেখানে বেসরকারি শিল্প উদ্যোগের ব্যাপক প্রাধান্য রয়েছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের উপস্থিতি নগণ্য মাত্র, সেই অর্থনীতি নাগরিকদের সহজলভ্য মূল্যে অত্যাবশ্যক পরিষেবা ও পণ্য প্রদানের সামাজিক লক্ষ্য তো পূরণ করতে পারেই না, তদুপরি স্বয়ম্ভরতা অর্জনের উপযুক্ত টেকনোলজিও আয়ত্ত করতে পারেনা। সবচেয়ে বড় কথা হল এহেন অর্থনীতি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয়। এই কথা বলার অর্থ এটা নয় যে কোন অর্থনীতিতে ব্যাপক বেসরকারি উদ্যোগের অস্তিত্ব থাকা মানেই সেই দেশটি নয়া ফ্যাসিবাদের খপ্পরে পড়েছে। এই কথা বলার অর্থ শুধু মাত্র এইটুকু যে এইরূপ অর্থনীতি নয়া ফ্যাসিবাদের হামলার মুখে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দুর্বল।
কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি দিমিত্রভ ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা নিরুপণ করতে গিয়ে বলেছিলেন ফ্যাসিবাদ হচ্ছে ‘লগ্নীপুঁজির সবচেয়ে প্রতিহিংসা পরায়ণ সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রকাশ্য একনায়ত্ব’। বিশপ মার্টিন নেইমোলার তার সাথে একটি বিখ্যাত ছোট্ট মন্তব্য যোগ করে সংজ্ঞাটি আরও প্রাঞ্জল করে বলেছিলেন, তারা (ফ্যাসিবাদীরা) ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে ধ্বংস করে, ইউনিয়ন নেতাদের ওপরে প্রাণঘাতী হামলা চালায়। কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে যে ফ্যাসিবাদের উত্থানের আর যা যা শর্ত থাকা দরকার, যথা অর্থনৈতিক সংকটের উপস্থিতি ইত্যাদি, তার সঙ্গে যুক্ত করা দরকার ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতি অথবা দুর্বল হয়ে পড়ার বিষয়টিকেও।
সুতরাং নয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেবল বিরোধী শক্তিগুলির রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনই যথেষ্ট নয়, শ্রমিক শ্রেণির শক্তি পুণরুদ্ধার করার রণনীতি আয়ত্ত করাও দরকার। এখন ভারতে যেমনটা ঘটছে, সেইরকম শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে সমন্বয় সাধন ক’রে নয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ময়দানে সমবেত হওয়ার ঘটনাবলী শ্রমিক শ্রেণির শক্তি পুনরুদ্ধারের পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।