ব্রেশ্ট্ আর স্তানিস্লাভস্কি সম্পর্কে পরিষ্কার আলাদা দুটি মত আছে। একটি হলো: দু’জনে দু-পথের পথিক, অভিনয় ও প্রযোজনার দুটি আলাদা ঘরানা। সিরিঅস নাটক ভালোভাবে করতে হলে এদের যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে।
অন্য মত হলো: দু-এর মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। যেমন, শম্ভু মিত্র লিখেছেন: আমি তাঁদের দু’জনেরই সৃষ্ট থিয়েটারে অভিনয় দেখেছি, তাঁদের অনুরাগীদের সঙ্গে আলাপ করেছি, এবং তাঁদের লেখাও কিছু কিছু পড়েছি। তাতে আমার তো দুটো পদ্ধতিকে এতো কিছু বিপরীত বলে মনে হয়নি।
পূর্ব জার্মানি থেকে চলে আসবার ঠিক আগে একটা আলোচনা সভা হয়েছিল। সেখানে সংস্কৃতি দপ্তরের লোক ছিলেন, কাগজের লোক ছিলেন, অভিনেতাদের ইউনিয়নের লোক ছিলেন, নাটমঞ্চের লোক ছিলেন। সেখানেও কথাটা আমি উত্থাপন করি এবং সকলেই বলেন যে দুটো পদ্ধতির মধ্যে কোন বিরোধ নেই।১
একই অভিজ্ঞতা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের:
আলোচনাচক্র বসে।…
বিতর্ক চলে, নানা প্রশ্নও ওঠে প্রশ্নের উত্তরে ঘোষিত হয়-
স্টানিস্লাভস্কি আর ব্রেশ্ট্ –
পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী পরিপন্থী নয় তো মোটেই।
স্টানিস্লাভস্কিই এক স্রোতে ভেসে বিপ্লবের প্রবাহে এগিয়ে গিয়ে ব্রেশট্ হয়ে গেছে।২
দুই পদ্ধতির তফাৎ নিয়ে যে ধারণা চালু আছে সেটি দূর করতে চেয়েছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তও। এ বাবদে আঞ্জেলিকা হারভিৎস্জ্ বলে এক জার্মান অভিনেত্রীর কথাও তাঁর বই-এ উদ্ধৃত হয়েছে (এর পাশাপাশি দু-এর বিরোধ নিয়ে মার্কিন অভিনেতা জোসেফ চাইকিন- এর বক্তব্যও দেওয়া আছে)।৩
মস্কো-বের্লিন-এর কোনো থিয়েটর দেখিনি, সুতরাং প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো মতই দিতে পারব না। কিন্তু তার যেটুকু ব্যাখ্যা- বিবরণ-বিশ্লেষণ পড়েছি, তাতে খটকা থেকেই যায়। সমন্বয়ের দিক থাকতেই পারে, কিন্তু মূলের বিরোধ তাতে মেটে না।
তফাৎ তো একেবারে গোড়ায়। অভিনয়ই স্তানিস্লাভ্স্কির মূল বিষয়। ভালো নাটক নিপুণভাবে মঞ্চস্থ করাটাই তার প্রথম ও শেষ লক্ষ্য। সেটিই তাঁর ‘সুপার টাস্ক’। অভিনেতাকেই তৈরি হতে হয় এর জন্যেই। মঞ্চে পা দেওয়া থেকে শুরু করে শেষ দৃশ্যের পর্দা পড়া পর্যন্ত চলা ফেরা-ওঠা-বসা ছকে দেওয়া থাকে। নাটক তাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, স্তানিস্লাভ্স্কির গোটা কাজটাই নাটমঞ্চের চৌহদ্দিতে। দর্শক এসে বসলেন, হলের আলো নিভল, পর্দা উঠল – স্তানিস্লাভ্স্কির কাজ শুরু হলো। নাটক শেষ। দর্শক একটা জিনিস শিখলেন: সত্যিকারের ভালো থিয়েটর কাকে বলে।
কোনো ভুল বোঝার অবকাশ যাতে না থাকে তাই খুব পরিষ্কার করে বলে রাখা উচিত: এটাও কম জিনিস নয়। এ ধরণের নান্দনিক অভিজ্ঞতা জীবনে একটা নতুন মাত্রা আনে। একে ছোটো করে দেখাটা বোকামি।
ব্রেশ্ট্-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। থিয়েটার তাঁর কাছে স্বসম্পূর্ণ কোনো লক্ষ্য নয়, অন্য উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র। থিয়েটার দেখে বেরিয়ে দর্শক কী করবে ব্রেশ্ট্-এর আসল চিন্তা সেই নিয়ে। দর্শকের অনুভূতির চেয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার জগৎকে ছুঁতে পারাই তাঁর কাছে বড়। মেসিংকাউফ আলাপ-এ তাই ‘নাট্যকার’ নন, ‘দার্শনিক’-ই ব্রেশ্ট্-এর মুখপাত্র। গোড়াতেই তিনি বলে নেন: যেসব ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে যার থেকে সে বুঝতে পারে সত্যিকারের জীবনের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, তেমন ঘটনার অনুকৃতি নিয়েই থিয়েটারের কারবার। তার জন্যেই তিনি থিয়েটার-এ আগ্রহী। একটা উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি একে ব্যবহার করতে চান।
অর্থাৎ স্তানিস্লাভ্স্কির কাছে অনুকৃতিই যেমন একমেবাদ্বিতীয় উদ্দেশ্য, ব্রেশ্ট্-এর কাছে তা নয়। বরং বাস্তবকে নিজের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অনুকৃত করে দেখানোই তাঁর বাসনা। তাতে যদি সেটা থিয়েটার না হয়, তাহলেও তাঁর কোনো আপত্তি নেই। এর একটা নতুন নাম, যেমন ‘থায়েটর’, দেওয়া যেতে পারে।৪
শুধু প্রযোজনা রীতি নিয়ে ব্রেশ্ট্-আর স্তানিস্লাভ্স্কির তুলনামূলক বিচার করলে তাই ব্রেশ্ট্-এর ওপর অবিচার করা হয়। নাটকের বক্তব্য নিয়ে স্তানিস্লাভ্স্কি খুব একটা মাথা ঘামাতেন কি? মনে হয় না। শেক্স্পিয়র, চেখভ, গোর্কি, অস্ত্রোভ্কি- সবার নাটকই তিনি প্রযোজনা করেছেন সমান দক্ষতা ও নিষ্ঠায়। অনুকৃতি হতো নিখুঁত। জীবনকে সেখানে দেখা যেত নাটকের ছকে।
ব্রেশট কিন্তু চেয়েছেন জীবনকেই সরাসরি মঞ্চে তুলে আনতে। নাটকের আখ্যান বা প্লটে যেসব দিক থাকে- সঙ্কটবিন্দু, পরিস্থিতির বিপত্তি, কেন্দ্রীয় ঘটনা, তুঙ্গমুহূর্ত, ইত্যাদি আরিস্তোতলের পরিভাষায়: আখ্যানের গেট বাধা আর খোলা (দেসিস আর লুসিস৫) তার সব কিছু পাল্টে ব্রেশ্ট্ তাই সচেতনভাবে রচনা করেন উপাখ্যানমূলক (এপিসোডিক) আখ্যান, যার প্রতিটি দৃশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ‘নাটকীয়তা’ বলতে যে কী হবে, কী হবে ভাব বা সাসপেন্স, ব্রেশ্ট্ তাকে পরিহার করেন সযত্নে। কোনো কোনো নাটকে দৃশ্যের গোড়ায় বলেই দেওয়া থাকে, এখন কী দেখানো হবে। আঙ্গিকের এই পরিবর্তন বিষয়েরই প্রয়োজনে।
স্তানিস্লাভ্স্কি যেসব নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন, সাহিত্যিক বিচারে সেগুলি ‘সুনাট্য’। তার কোনোটাই তাঁর লেখা নয়। অন্যদিকে ব্রেশ্ট্- এর প্রধান পরিচয়: তিনি নতুন ধরনের নাট্যকার। নিজের মতামত বলার জন্যেই তাঁর নাটক লেখা। সে মতামত যাতে ঠিকমতো হাজির করা যায়, তার প্রয়োজনেই তাঁর নিজের ধরনের প্রযোজনা। এমনকি, বের্লিনের অ্যাসেম্বল-এর রিপোর্টরিতে যেসব ধ্রুপদী নাটকের অভিনয় হতো সেগুলির প্রযোজনার ধরন ছিল আলাদা।
সোফোক্লেস-এর আন্তিগোনে নাটকটি ব্রেশ্ট্ যেভাবে মঞ্চস্থ করেছিলেন তার ধরনটাই দেখা যাক। প্রতিটি চরিত্র সর্বক্ষণ মঞ্চে হাজির থাকে। প্রবেশ-প্রস্থান বলে কোনো ব্যাপার নেই। যার যখন পালা আসে, জায়গা ছেড়ে উঠে অভিনয় করে, আবার নিজের জায়গায় ফিরে যায়। মঞ্চ কখনও অন্ধকার হয় না, নাটকের মেজাজ অনুযায়ী আলো কমে বাড়ে না। কেন? ব্রেশ্ট্ বলেছেন: দর্শক যেন কখনোই ভাবতে না পারে যে তাকে গল্পের জায়গায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে যেন যোগ দিতে পারে প্রাচীন এক কাব্যের উপস্থাপনায়।
এই অভিনয়ের দৃশ্যপট তৈরি করেছিলেন পাকা কারিগরের দল। তারও কারণ এই নয় যে, অভিনেতা বা দর্শক সেগুলো সত্যি বলে মনে করবেন। তাঁদের সামনে কিছু সুন্দর দৃশ্য রাখাটাই ছিল উদ্দেশ্য। স্তানিস্লাভ্স্কি যদি আন্তিগোনে মঞ্চস্থ করতেন (জানি না করেছিলেন কিনা) তাহলে তাঁর চেষ্টা হতো দর্শককে সেই নাটকের যুগে নিয়ে যাওয়া। থিয়েটারের ভেতরে সময়ের ব্যবধানটাই ঘুচিয়ে দিতেন তিনি।
নিজে অভিনেতা ছিলেন বলেই হয়তো স্তানিস্লাভ্স্কি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন ‘চরিত্র’-র ওপর। ‘চরিত্র’ অর্থাৎ নাটকের পাত্রপাত্রী কিভাবে হাঁটবে, চলবে, কখন গলা তুলবে নামাবে- এই ছিল তাঁর প্রযোজনার মূল চিন্তা। অন্য অনেক বিষয়ে আরিস্তোতলের বিরোধি হলেও অদ্ভুত একটি ব্যাপারে ব্রেশ্ট্ কিন্তু তাঁর সঙ্গে একমত: চরিত্র নয়, আখ্যানই নাটকের প্রাণ।৭ চরিত্রের ওপর জোর দিলে দর্শকের দিক থেকে সমানুভূতি বা এমপ্যাথির ব্যাপারটা অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। ফলে নিয়তির অলক্ষ্য শক্তিই বড় হয়ে ওঠে। সে নিয়তির লিখন বদলানো যায় কিনা- এ প্রশ্নই আর দর্শকের মনে জাগে না। অথচ এই প্রশ্ন বাদ দিয়ে ব্রেশ্ট্-এর কোনো মহৎ নাটক- ককেশীয় খড়ির গণ্ডি, সেৎসুআন-এর ভালো মানুষ বা গ্যালিলেও-র জীবন- কল্পনা করাই শক্ত।
প্রযোজক-অভিনেতা স্তানিস্লাভস্কির কাছে কিন্তু এসব প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক ছিল না। সব মিলিয়ে তাই মনে হয়, শুধু প্রযোজনা পরিচালনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রেশ্ট্-স্তানিস্লাভ্স্কির বিচার অসঙ্গত ও অসমীচীন।
আদতে ব্রেশ্ট্ ছিলেন বিপ্লবী চিন্তাবিদ। নাটক তাঁর সমাজদর্শন প্রকাশের ও প্রচারের মাধ্যম। সেই মাধ্যমের উপযোগী প্রযোজনার ধাঁচও তাঁকে তৈরি করে নিতে হয়েছিল। চীনে ও জাপানি থিয়েটারের সঙ্গে সঙ্গে স্তানিস্লাভ্স্কির কাছ থেকেও তিনি অনেক কিছু শিখেছিলেন। কিন্তু স্তানিস্লাভ্স্কির চেতনায় ‘সমাজের প্রতি দায়িত্ব… মানুষের মহত্ব’ ইত্যাদি যেসব সদ্গুণ থাকে (ব্রেশ্ট্ও এগুলির প্রশংসা করেছেন)৮ তার সঙ্গে ব্রেশ্ট্-এর বৈজ্ঞানিক সমাজবাদী ধারনাকে এক করে দেখলে ভুল হবে। নিছক সদিচ্ছা আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অত অনায়াসে মেলে না।
উৎপল দত্তও, মনে হয়, এ বাবদে একটা তত্ত্বগত ভুল করেছেন। সম্পূর্ণ অমার্কসীয় কায়দায় আঙ্গিক ও বিষয়কে আলাদা করে দেখে, অন্য অনেক নাট্যবিদের মতো তিনিও এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, দুটি ধারায় কোনো বিরোধ তো নেই-ই, বরঞ্চ তারা ‘পরস্পরের পরিপূরক’।৯ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের এত মৌলিক পার্থক্য থাকলে একটি অন্যের পরিপূরক হতে পারে না।
একটা গল্প দিয়ে এই প্রসঙ্গের ছেদ টানা যাক।
ক্যাটে রুলিকে-ভাইলার জানিয়েছেন, ১৯৫৫-য় ব্রেশ্ট্ মস্কো আর্টস থিয়েটারের অস্ত্রোভ্স্কির লেখা একটি নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। হল থেকে বেরনোর সময় ছদ্ম-দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্রেশ্ট্ বললেন, ‘এখন আমায় স্তানিস্লাভ্স্কিকে তাঁর সমর্থকদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। লোকে আমার সম্পর্কে যা বলে, এখন তাঁর সম্পর্কে আমাকে তাই বলতে হবে প্রয়োগ আর তত্ত্ব মেলে না।১০
এ হলো মিলের দিক। প্রয়োগবিদ্ যখন তাত্ত্বিক হন, বা তার উলটো সেখানে এমন ঘটবেই। কিন্তু, ঐ প্রযোজনায় ‘অনন্বয়ের মাত্রা’ দেখে অবাক হলেও, ব্রেশ্ট্ দুঃখ করেছিলেন: শ্রেণিসংগ্রামের দিকটির ওপর যথেষ্ট জোর পড়েনি। অস্ত্রোভ্স্কির নাটকের সৌন্দর্য তাই পুরোপুরি ফুটে ওঠেনি।
অনেক বড় বড় তত্ত্বকথার চেয়ে এই ঘটনাটি দু’জনের গরমিল আরও ভালো করে বুঝিয়ে দেয়।